ছবি:সময়ের সন্ধানে
র্যাপিট আ্যাকশন ব্যাটালিয়নকে (র্যাব) বিলুপ্ত করার সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। এরই মধ্যে সরকারের পুলিশ সংস্কার কমিটির কাছে এই সুপারিশ করেছে দলটি।
মঙ্গলবার (০৯ ডিসেম্বর) সকালে রাজধানীর গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও বিএনপির পুলিশ সংস্কার কমিটির প্রধান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, সরকারের পুলিশ সংস্কার কমিটি বিএনপির কাছে সুপারিশ না চাইলেও আমরা সুপারিশমালা দিয়েছি। রাষ্ট্রের এই অত্যাবশ্যকীয় সেবার (পুলিশ) সংস্কার এখন সময়ের দাবি। সুপারিশমালায় বিএনপি পুলিশ কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছে বলে জানান হাফিজ।
তিনি বলেন, পুলিশের বিভিন্ন স্তরের অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তকাদের সঙ্গে কথা বলেছি। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছি। অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি। জনগণের সঙ্গে পুলিশের দুরত্ব কমানোর সুপারিশ করেছি আমরা।
বিএনপির দেওয়া সুপারিশমালাঃ
১। পুলিশ বাহিনীকে সঠিক দিক নির্দেশনা, পরামর্শ এবং সহায়তা প্রদানের জন্য একটি পুলিশ কমিশন গঠন করা প্রয়োজন। কমিশনের কার্য পরিধির মধ্যে থাকবে- (ক) পুলিশের জনবান্ধব ও গ্রহণযোগ্য আচরণ নিশ্চিত করা।
(খ) বাহিনীর কল্যাণ ও উন্নয়নে পদক্ষেপ গ্রহণ।
(গ) বাহিনী পরিচালনায় প্রয়োজনীয় আইন ও বিধি প্রণয়ন।
(ঘ) বাহিনীর সম্প্রসারণ ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি সংগ্রহ।
(ঙ) সদস্যদের দক্ষতা বৃদ্ধিকল্পে উন্নত বিশ্বের অনুকরণে আধুনিক প্রশিক্ষণ প্রদান।
(চ) সর্বোচ্চ বিভাগীয় কমান্ড কর্তৃক প্রচলিত আইন ও বিধির ব্যত্যয় ঘটার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ।
(ছ) রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ন ইস্যুতে পুলিশকে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা প্রদান।
(জ) দায়িত্ব পালনকালে দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির গুরুতর অবনতি রোধকল্পে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান।
(ঝ) সরকার কর্তৃক নির্দেশিত বিশেষ দায়িত্ব পালন।
কমিশনের চেয়ারম্যান হবেন- স্বরাষ্ট্র বিষয়ক সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান। সদস্য হবেন ৮ (আট) জন। সরকার দলীয় সংসদ সদস্য (২), বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্য (১), বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক (১), উচ্চ আদালতের আইনজীবী (১), সমাজের বিশিষ্ট নাগরিক (২), স্বরাষ্ট্র সচিব মনোনীত অতিরিক্ত সচিব (১)।
আইজিপি মনোনীত একজন অ্যাডিশনাল আইজি হবেন সদস্য সচিব। জাতীয় সংসদ বলবৎ না থাকলে অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত একজন বিচারক। সরকার বিধি-বিধান দ্বারা এই কমিশনের সদস্য নির্বাচন পদ্ধতি, কাজের পরিধি ও কর্মকাল নির্ধারণ করবেন।
২। স্থানীয় পর্যায়ে পুলিশকে অপরাধ দমনে সহায়তা প্রদান, জনসাধারণ পুলিশ সম্পর্ক উন্নয়নে এবং সংশ্লিষ্ট এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পরামর্শ প্রদানের জন্য প্রত্যেক উপজেলা/থানায় একটি নাগরিক কমিটি গঠন করা হবে। স্থানীয় গণ্যমান্য, সুশিক্ষিত ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তির সমন্বয়ে এ কমিটি গঠিত হবে।
কমিটির সভাপতি হবেন একজন স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তি। সদস্য সচিব হবেন সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। এছাড়াও ০২ (দুই) জন ইউপি সদস্য, ০১ (এক) জন শিক্ষক, ০১ (এক) জন ব্যবসায়ী, ০১ (এক) জন পেশ ইমাম এবং সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলের স্থানীয় প্রতিনিধি কমিটির সদস্য হিসেবে থাকবেন। সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকার সংসদ সদস্য স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যানের সঙ্গে পরামর্শ করে ২ (দুই) বছর সময়কালের জন্য এই নাগরিক কমিটি গঠন করবেন।
৩। পুলিশের সাংগঠনিক কাঠামোতে থাকা র্যাব ইতোমধ্যে দেশে এবং বিদেশে ব্যাপকভাবে নিন্দিত ও সমালোচিত হয়েছে। দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠন, জাতিসংঘ, অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এবং সুধীজন র্যাবকে দেশে সংঘটিত অধিকাংশ গুম, খুন, নির্যাতন ও নিপীড়নের জন্য দায়ী করেছে। বাহিনীটি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার আওতায় আছে। এই প্রেক্ষাপটে র্যাবকে বিলুপ্ত করার সুপারিশ করা হলো। র্যাবের দায়িত্ব আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন এবং থানা পুলিশ যেন পালন করতে পারে সেই লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৪। কমিউনিটি কর্তৃক পরিচালিত পুলিশি ব্যবস্থাকেই বলা হয় কমিউনিটি পুলিশিং। এর উদ্দেশ্য হলো জনগণের সাথে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে অপরাধ দমন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ও সামাজিক সমস্যাদি সমাধানে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা। কমিউনিটি পুলিশিংয়ের মাধ্যমে সমাজে বিবিধ অপরাধ প্রবনতা এবং সামাজিক অস্থিরতা কমবে, পুলিশ-জনসাধারণের মধ্যে দূরত্ব হ্রাস পাবে, জনসচেতনতা বৃদ্ধি করবে এবং আইনের শাসন জোরালো হবে।
এই উদ্দেশ্যে গ্রামাঞ্চলে প্রতিটি ইউনিয়নে এবং শহরাঞ্চলে প্রতিটি ওয়ার্ডে কমপক্ষে ১জন অবসরপ্রাপ্ত কম্যুনিটি পুলিশ অফিসার (সাব-ইন্সপেক্টর পদের নিম্নে নয়) নিয়োজিত হবেন। সংশ্লিষ্ট এলাকায় তার একটি অস্থায়ী দপ্তর থাকবে। উক্ত অফিসার নিয়মিতভাবে এলাকার গণপ্রতিনিধি, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান, ইমাম, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি, মহিলা সমাজ, কৃষক ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধি সমন্বয়ে গঠিত কমিটির সংগে নিয়মিত বৈঠক করবেন। সকলের অংশগ্রহণে প্রাপ্ত সহযোগিতা ও পরামর্শ নিয়ে কম্যুনিটি পুলিশ অফিসার সংশ্লিষ্ট এলাকায় অপরাধ দমন ও নিবারণে দৃশ্যমান ব্যবস্থা গ্রহন করবেন।
এছাড়াও এলাকায় জমি সীমানা, সম্পদ মালিকানা, মানহানি বা অন্য কারণে অধিবাসীদের মধ্যে মতবিরোধ, গৃহবিবাদ, শিশু ও নারী নির্যাতন, মাদক গ্রহণ, জুয়াখেলা, সুদব্যবসা, গ্যাং কালচার, সাম্প্রদায়িক উস্কানি ইত্যাদি আলোচনা করে সমাধানের চেষ্টা চালাবেন। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে আইনী পরামর্শ ও সহযোগিতা প্রদান করবেন। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পুলিশ ও জনগণ মিলে নিরাপত্তা পেট্রোলিংয়ের ব্যবস্থা নিবেন। নিয়োজিত কমিউনিটি পুলিশ অফিসারের বেতন-ভাতা সংশ্লিষ্ট স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষ বহন করবেন।
কম্যুনিটি পুলিশ অফিসার প্রতিমাসে তার গৃহীত কার্যক্রম সম্পর্কে উপজেলা/থানা নাগরিক কমিটি এবং ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বরাবর একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন দাখিল করবেন। ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উক্ত প্রতিবেদনে তার নিজের গৃহীত ব্যবস্থার বিবরণ লিপিবদ্ধ করে তা সার্কেল এএসপি/জোনাল এসির মাধ্যমে এসপি/ক্রাইম ডিসির নিকট প্রেরণ করবেন। এসপি/ক্রাইম ডিসি যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন করে একটি সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন পুলিশ সদর দপ্তরে প্রেরণ করবেন। পুলিশ সদর দপ্তরে কমপক্ষে একজন অ্যাডিশনাল আইজি সারাদেশের এই কম্যুনিটি পুলিশংয়ের কার্যক্রম মনিটর করবেন এবং কর্তৃপক্ষের আদেশ নির্দেশ ও দিক নির্দেশনা মাঠপর্যায়ে প্রতিপালনের জন্য প্রেরণ করবেন। প্রতিমাসে প্রতি থানায় ‘শ্রেষ্ঠ কম্যুনিটি পুলিশ অফিসার’ নির্ধারণ করা হবে এবং তাকে যথাযথ পুরস্কারে ভূষিত করা হবে।
৫। বাংলাদেশ পুলিশে বর্তমান জনবল প্রায় সোয়া ২(দুই) লাখ। এদের সঙ্গে পরিবারের সদস্য সংখ্যা যুক্ত হলে তা দাড়ায় প্রায় সাড়ে ৮ (আট) লাক। এদের চিকিৎসা সেবা প্রদান করার দায়িত্ব প্রতিটি বিভাগ বা জেলায় স্থাপিত পুলিশ হাসপাতালের। বর্তমানে এই সেবা বেশ অপ্রতুল বিধায় প্রতিটি জেলা শহরে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি ও জনবলসহ পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল স্থাপন/সম্প্রসারণ করতে হবে।
কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল, রাজারবাগ, ঢাকা ছাড়া অন্য কোন বিভাগীয়/জেলা হাসপাতালের কোথাও প্রয়োজনীয় চিকিৎসক, টেকনিশিয়ান বা সরঞ্জামাদি নেই। কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও তাদের সন্তান-সন্ততিদের চিকিৎসা সেবা প্রদানে রাজধানী ঢাকার কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের অনুরূপ প্রতিটি বিভাগীয়/মেট্রোপলিটন শহরে বিভাগীয় পুলিশ হাসপাতাল পরিচালনা করা যেতে পারে। এ লক্ষে প্রয়োজনীয় ডাক্তার, টেকনিশিয়ান এবং যন্ত্রপাতি সন্নিবেশনের প্রয়োজন হবে।