|| হাসান আল মাহমুদ ||
আজকাল শহুরে সমাজে আয়েশী পরিবারগুলোতে বিদেশি বিড়াল পালার হিড়িক পড়েছে। সমীক্ষায় দেখা গেছে, এই পরিবারগুলোর বেশিরভাগের কোনো পিছুটান নেই, শহরে বাড়ি কিংবা নিজেদের ফ্ল্যাট আছে, অর্থকড়িও ভালো। জীবনে চলার জন্য যতটুকু সুখ দরকার তারচে কোনো অংশে কম নেই তাদের। এই সুখকে আরো রোমাঞ্চকর করতেই কি না বিড়াল পোষে প্রায় সকল আয়েশী পরিবারগুলো! বিড়ালকে শ্যাম্পু দিয়ে গোসল, তার জন্য খাবার প্রস্তুত করা, তাকে খাবার খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো, সঙ্গে করে ঘুরে বেড়ানোসহ তাকে নিয়ে নানা ব্যস্ত সময় পার করতে দেখা গেছে সরেজমিনে।
মেয়েদের পছন্দ বিড়াল-
গবেষণায় দেখা গেছে, বেশিরভাগ ছেলেদের পছন্দ কবুতর আর বেশিরভাগ মেয়েদের পছন্দ বিড়াল পোষা। স্কুল কংবা মাদরাসা পড়ুয়া সর্বশ্রেণির মানুষের কাছে বিড়াল পোষা একটা নেশার মত হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি বিড়ালের প্রতি তাদের এতো মায়া আর আহ্লাদ, যা অন্য কারো প্রতি নেই বলে জানা গেছে। বিড়ালের সাথে নানা অঙ্গভঙ্গির সেলফি তুলে ফেসবুকেও পোস্ট করছে কেউ কেউ।
বিড়ালের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি-
মাদরাসা পড়ুয়া মেয়ে কাশফিয়া আহমেদ ফেসবুকে বিড়ালের দুটি ছবি পোস্ট করে লিখেন, ‘আমার দুই সন্তান’। তাদের মতো মায়া আর কোনোটাতেই আনতে পারি না। যতই বলেন, ওরা সামান্য বিলাই, কিন্তু মায়া মানুষের মনে বইসা যায় একদম মনের অতল গভীরে।’
বিড়াল প্রিয় না একটি মানব শিশু-
স্কুল পড়ুয়া পরিচিত এক মেয়ে জুবাইদা। বিড়ালকে সাথে নিয়ে ঘুরে, তাকে খাওয়ায়, গোসল করায় এবং সঙ্গে নিয়েও ঘুমায়। তার কাছে জানতে চাওয়া হয় বিড়াল না পোষে মানুষ পোষা ভালো না? উত্তরে সে তীব্র আওয়াজে বলে ওঠলো, ‘না, একদম কখনোই না।’ তাকে প্রশ্ন করা হয়, আচ্ছা মনে করো, তোমার বড় ভায়ের একটা বেবি হলো, তখন তোমার কাছে এই বিড়াল প্রিয় হবে না ভায়ের সন্তান? কাকে বেশি আদর করবা? এমন প্রশ্নে সে কোনোরকম চিন্তা ছাড়াই বলে দিলো ‘বিড়াল’।
বিশাল অর্থ ব্যয়ে বিড়াল পোষার কারণ-
বিড়াল কেনা, পোষার কারণ ও তাদের জন্য অর্থ ব্যয় ইত্যাদি বিষয়ে রাজধানীর কয়েকটি ফ্যামিলির সঙ্গে কথা বলে পাওয়া গেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। তারা জানিয়েছে, বাংলাদেশি আমদানি করা একটি বিদেশি বিড়ালের দাম পড়ে ৬ থেকে ৫০ হাজার টাকায়। তারপর, এই বিড়ালের জন্য খাবার বাবদ মাসিক খরচ হয় প্রায় ১০ হাজার টাকা কিংবা এরচে কম-বেশি। এই এতো অর্থ ব্যয় করে কেন বিড়াল পোষেন, এরচে মানুষ কেন পোষেন না? জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক (পরিচিত) এক ভদ্র মহিলা জানান, বিড়াল পোষতে ভালো লাগে, সহজেই তারা পোষ মানে। একটু আদর দিলেই তারা সঙ্গী হয়ে যায়। বেশি একটা জালাতন করে না।’
সন্তানের চেয়েও বিড়ালের প্রতি বেশি যত্ন –
কিন্তু আপনাকে তো দেখছি নিজের সন্তানের প্রতিও অতো যত্ন নেন না, যতোটা বিড়ালের প্রতি রাখেন? এমন প্রশ্নে তাকে একটুও বিচলিত দেখা যায়নি। বরং মুখে হাসি লাগিয়েই বলে ওঠলেন ‘আমার সন্তানেরও একটা বিড়াল আছে, সে তাকে নিয়ে থাকে আর আমি আমার জেরিকে (বিড়ালের নাম) নিয়ে।’
বিড়ালের প্রজাতি –
‘ডল ফেস’, ‘প্রেকে-ফেস’, ‘এক্সটিক শর্টহেয়ার’ এবং ‘টিকাপ’ সাধারণত চারটি প্রজাতির বিড়াল দেখা যায়। তার মধ্যে পুতুলের মতো মুখ বিশিষ্ট পার্সিয়ান বিড়ালের কদর বেশি। দামের দিক থেকেও এই প্রজাতিটির স্থান বেশ উঁচুতে। তাই তার দামও সর্বোচ্চ পর্যায়ের বলে জানা গেছে আনন্দবাজার পত্রিকার রিপোর্ট থেকে।
বিড়ালের দাম-
গুগল সার্চ করলে বিক্রয়ডটকমে একটি বিড়ালের দাম ২ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকায় দেখা যাচ্ছে। পার্সিয়ান বিড়ালেরও বিভিন্ন প্রজাতি রয়েছে। যত উন্নত প্রজাতি দামও তত বেশি। পারস্য দেশ থেকে আমদানি করা এই প্রজাতির বিড়াল কিনতে গেলে বাজেট রাখতে হবে ৮ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা প্রর্যন্ত। শরীরের আকার, লোমের মান, চোখের মণির রং, স্বভাব এর উপর দাম নির্ভর করে বলে জানিয়েছেন রাজধানীর কাটাবনের এক বিড়াল বিক্রেতা।
বিড়ালের হাট-
অনুসন্ধানে দেখা দেখা গেছে রাজধানী ঢাকার নিউ মার্কেট, ঢাকা ইউনিভার্সিটির আশেপাশে এলাকাগুলোতে বিড়ালের দোকান রয়েছে। রাজধানীর ঢাকার কাটাবনে বিড়ালের মার্কেট রয়েছে। সেখানের একটি দোকানের নাম ‘প্র্রীটি বার্ডস-১’। এ দোকানের মালিক এক ইউটিউব ভিডিওতে জানান, ৪৫ দিন বয়সের একটা কেলিগো বিড়াল ৬ থেকে সাতটা বাচ্চা দিতে পারে। তার দাম হাঁকান তিনি ২০ হাজার টাকা। এছাড়া তিনি বিড়াল ক্রেতাদের আহ্বান করে বলেন, ‘অনেকে বিড়াল কিনতে আসেন কিন্তু পালার নিয়ম জানেন না। তাই আমি বলব অবশ্য কেনার আগে পালার নিয়মটাও জেনে নিবেন আমার কাছ থেকে। দুইটা কেনার চেষ্টা করবেন। কারণ, একটা থাকলে তার মন খারাপ থাকে।’
বিড়ালের খাবার-
বিড়াল পালে এমন পরিবার থেকে বিড়ালের খাবার সম্পর্কে জানা যায় চমৎকার তথ্য। তারা জানান, ‘তাদের নরমাল খাবার হলো জেলি, চিকেন। মিষ্টি কুমড়া, গাজর বেলেন্ডারে নরম করে খাওয়াতে হয়। তারা আরো জানান, ওদেরকে মাঝে মাঝে ওরস্যালাইন গুলে পানি খাওয়াই। মাছ পছন্দ হলেও কাঁটা বেছে দিতে হয়। না হলে গলায় বিঁধে যেতে পারে। টুনা, স্যামনের মতো সামুদ্রিক মাছ যেমন প্র্রিয়, তেমনই টিনজাত খাবার খেতেও ভালোবাসে এরা। এ ছাড়া হাড় ছাড়া মুরগি সেদ্ধ করে খাওয়াই।’
বিড়ালের পার্লার –
বিড়ালকে সুন্দর ও পরিপাটি করে রাখতে তাকে শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করিয়ে তার পশমগুলো আঁচড়িয়েও দিতে হয়। তাকে পাউডার, শ্যাম্পু, ব্রাশ, নখ কাটার নেলকাটার, চিড়ুনিসহ পার্লার করার নানা আসবাবপত্র দিতে হয়। সে সঙ্গে বিড়ালকে আনন্দে রাখতে দিতে হয় তাকে সময়। তার মনোরঞ্জনের জন্য তাকে নানা খেলনাসামগ্রীও দিতে হয়। রোবিটিক মাউস, প্লাস্টিক ও রাবারের বল, স্টাফ মাউস, খেলনা জাতীয় পশুপাখি, ইউইজা, হেক্সবুগ ন্যানো, বেটারি চালিত বিড়াল খেলনাসহ নানা খেলনা জিনিসপত্র তাকে দিকে দিলে বিড়াল খুশি ও আনন্দে থাকে বলে জানান বিড়াল পালে এমন পরিবারগুলো।
বিশাল অর্থ ব্যয়ে বিড়াল পালার রহস্য-
টয়েটা, পিংকি, মেরি ও জেলিন নামে পরিচিতি মিরপুরের এক বিত্তশালী পরিবারের চারজন সদস্যেরই রয়েছে আলাদা আলাদা চারটি বিড়াল। বিড়ালগুলোর দাম যেমন আকশ ছোঁয়া, তাদের খাবারের মানও অনেক উন্নত। প্রতিযোগিতা করে ব্যয় হয় তাদের জন্য অনেক টাকা। এতো অর্থ ব্যয়ে বিড়াল পালার বিলাসিতা কেন? এমন প্রশ্ন পরিচিত এই পরিবারের কাছে রাখলে, তারা উল্টো প্রশ্ন ছুঁড়েন ‘বিড়াল পালা কি নাজায়েয কিছু?’ সে সঙ্গে তারা হাদিসে বিড়াল প্রসঙ্গ তুলে ধরে তার ফযীলত ও সওয়াবের কথা তুলে ধরেন।
বিড়াল পালে আরেক পরিবারের কাছে ‘বিড়াল কিনে পালতে হবে কেন’? এমন প্রশ্ন ছুঁড়লে তারা ইউটিউবে শোনা শায়খ আহমাদুল্লাহ -এর বয়ানের কথা মেলে ধরে ‘বিড়াল কেনা জায়েয’ করার স্বপক্ষ প্রমাণ দেন।
ইউটিউবে কী বলেছেন শায়খ আহমাদুল্লাহ?
অনলাইন জগতে অনেক পরিচিত ইসলামি আলোচক শায়খ আহমাদুল্লাহ ‘বিড়াল কেনা’ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘হাদিসে নরমালি বিড়াল কেনাবেচা নিষেধ করা হয়েছে। মুহাদ্দিস বা হাদিস বিশেষজ্ঞগণ এর ব্যখ্যায় বলেন, এর মানে হলো বিড়াল বিক্রি করার জিনিস নয়। সাধারণ জিনিসের বিক্রি কেন করবে মানুষ। কিন্তু বিড়াল যদি প্রশিক্ষিত হয়, সেটার পিছনে অনেক খরচা হয় আজকাল যেমনটা হচ্ছে, বিশেষ কেইটেরিয়াল হয়, তাহলে সেক্ষেত্রে বিড়াল বিক্রি করাকে অনেক ওলামায়ে কেরাম জায়েয বলেছেনÑ প্র্রাথমিক গবেষণার আলোকে। অবশ্য অনেক ওলামায়ে কেরাম সাধারণ অর্থেই যেহেতু বিড়াল কেনাবেচা হাদিসে নিষেধ করা হয়েছে, এজন্য তারা সব ধরণের বিড়াল বিক্রি করাকে নাজায়েয বলেন।
তিনি বলেন, ‘যদিও বিড়াল বিক্রি সংক্রান্ত যে হাদিস রয়েছে, সে হাদিসের আলোকে বিড়াল বিক্রি করাকে কেউ হারাম কেউ বলেন না, মাকরূহ বলেছেন অনেকে। অর্থাৎ এটা অনুচিত অনুত্তম।
তিনি আরো বলেন, তাকওয়ার দাবিতো হলো বিড়াল বিক্রি না করা। বাট, যদি ভ্যালুএবল বিশেষ বিড়াল হয়, তাহলে আমি এক্ষেত্রে বিড়াল বিক্রি করাকে নাজায়েয মনে করি না। আমার দৃষ্টিকোণ থেকে এবং যেসকল হাদিসবিদগণ বলেছেন তাদের কথাকে আমি যৌক্তিক ও সঠিক মনে করি।’
বর্তমান অবস্থার আলোকে শায়খ আহমাদুল্লাহ এর পক্ষ থেকে এ বিষয়টির ব্যাখ্যা জানতে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ‘আমি এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেনি, স্বাভাবিক কাজকামও পারি না। তাই এ বিষয়ে এখন কিছু বলতে পারছি না।’
‘লক্ষ টাকায় বিড়াল কিনে উচ্চাবিলাসী করা ইসলাম নয়’-
ত্রিশ-চল্লিশ হাজার টাকা দিয়ে বিড়াল কিনে এর জন্য মাসে মাসে হাজার হাজার টাকা ব্যয় করতে হয়। এভাবে ব্যয় করে বিড়াল পোষতে হবে কেন? এতে ইসলামের কোনো দৃষ্টিভঙ্গি আছে কি না? এমন প্র্রশ্ন রাখলে বিশিষ্ট গবেষক আলেম ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপপরিচালক ড. মাওলানা মুশতাক আহমদ জানান, ‘সমাজে বিড়াল পালনের যে তথ্য আপনি দিলেন তা সম্পর্কে আমার পড়াশোনা নেই। তবে, ইসলাম খামাখা এভাবে বিড়াল পালনের কথা বলে নাই। হজরত আবু হুরায়রা রা. বিড়াল পালতেন। এর দ্বারা এ বিষয়টা এমন হয়ে যায়নি যে বিড়াল পালাটা সুন্নাত হয়ে যাবে।
সমাজে বিড়াল পালার হিড়িকের কথা জানালে তিনি আশংকা ব্যক্ত করে বলেন, ‘এখন বিড়ালকে নিজের বিছানায় রাখছে, কোলো করে নিয়ে হাঁটছে। এমন রুচি পশ্চিমা দেশের মতো না জানি আবার কুকুরের দিকেও যায় কি না।’
তিনি বলেন, ‘হাদিস আমাদের শিক্ষা দেয় বিড়াল, কুকুর বা যে কোনো অবলা প্র্রাণীকে অকারণে কষ্ট দেওয়া হারাম। বরং আল্লাহর মাখলুক হিসাবে এদের প্র্রতি দয়া করা আমাদের কর্তব্য। বিদেশ থেকে লক্ষ টাকায় বিড়াল কিনে এনে উচ্চাবিলাসী ইসলাম নয়।’
‘অর্থ ব্যয় করে বিড়াল পালন ইসলাম অনুৎসাহিত করে’-
অর্থ ব্যয় করে বিড়াল পালা সওয়াবের কাজ কী না? জানতে চওয়া হলে জামিয়া রাহমানিয়া আজিজিয়া, মোহাম্মদপুর, ঢাকা’র মুঈনে মুফতী মুফতি তাওহীদুল ইসলাম জানান, ‘মানুষের অর্থ ব্যয় করার জন্য বিড়ালের চেয়ে আরো অনেক জরুরি খাত রয়েছে। সেগুলোতে অর্থ ব্যয় করুক। অনেক গরীব মানুষ না খেয়ে থাকছে, তাদের চেয়ে বিড়াল পালাটা জরুরি নয়। এটা অপ্র্রয়োজনীয় কাজ। সাহাবায়ে কেরামের মাঝে বিড়াল পালার যে ব্যাপারটা হাদিসে এসেছে, সেসব বিড়াল হলো আশেপাাশে ঘোরাঘুরি করার বিড়াল, যা আমাদের গ্রাম এলাকায় দেখা যায়। এসব বিড়াল কেনার তো প্র্রশ্নই ওঠে না।
তিনি জানান, ‘বিড়াল পালা নিয়ে ইসলামে কোনো সমস্যা নেই, বিড়াল পালতে পারবে। কিন্তু বিড়ালের জন্য হাজার কিংবা লক্ষ টাকা ব্যয় করার যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে এটাকে এক ধরণের ফ্যাশন হিসাবে গ্রহণ করায় ইসলামি শরীয়ত উৎসাহিত করে না। এভাবে বিশাল অর্থ ব্যয় ইসলাম অনুৎসাহিত করে।
‘বিড়ালের জন্য ১০ হাজার, অথচ কাজের বুয়ার পরিবার চলে না’-
বর্তমান শহুরে সমাজে বিড়াল পালার সার্বিক বিষয় তুলে ধরে বিশিষ্ট গবেষক লেখক মুফতি ড. আব্দুল মুকিত আযহারী জানান, ‘বিড়াল পালা ইসলামের দৃষ্টিতে নাজায়েযের কিছু নয়। কারণ, হাদিসে এসেছে হজরত আবু হুরায়রা রা. তার নাম আবু হুরায়রা ছিল না। যেহেতু তিনি বিড়াল পালতেন, এজন্য তাঁকে ‘আবু হুরায়রা’ তথা বিড়ালের বাবা হিসাবে উপাধী দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে বিড়াল পালা নিয়ে যে সমস্যা দেখা যাচ্ছে, তা হলো অতিমাত্রায় অপব্যয়। অনেকে বিড়াল পালার নামে অনেক অপচয় করছে। এটা হলো গুনাহ। যে কোনো অপচয়ই তো গুনাহ।’
তিনি জানান, ‘আমার পরিচিত কিছু লোক আছে, তারা বিড়ালই কিনেছে ৫০ হাজার টাকায়। এ বিড়াল বিদেশি একধরণের আয়েশী ব্রাউন বিড়াল। আবার এসব বিড়াল কেনা পর্যন্তই শেষ না, এগুলোর জন্য দামি দামি খাবারও দিতে হয়। এরা নরমাল খাবার খেতে পারে না। খায় কেটলি খাবার।
তিনি জানান, ‘আমার দেখামতে বিড়ালের প্র্রতি মানুষের এতো ভালোবাসা আর টান যে, বিড়াল ছাড়া সে কিছু ভাবতেও পারে না। একজনের একটা বিড়াল হারিয়েছে, সে মহিলা কানতে কানতে শেষ। মনে হয় যেন তার বাচ্চা হারিয়েছে!’
তিনি জানান, ‘অনেক সময় দেখা যায়, বিড়ালের কারণে কেউ কেউ বাচ্চাও নেয় না। কারণ বিড়ালের প্র্রতি তার ভালোবাসা এতোটা জন্মে গেছে যে, তার আর বাচ্চা নেওয়ার প্র্রয়োজন পড়ে না। এমনও শুনেছি। আমার পরিচিত এক কলিগ, তার বাচ্চা হয় না। একদিন সে কথাপ্র্রসঙ্গে জানালো তার পারিবারিক বিষয়। জানালো, তার ওয়াইফের তো বাচ্চা হচ্ছে না, তাই সে আজকাল বিড়াল পালা শুরু করছে। আর সে একেবারে পাগলের মতো বিড়াল পালছে। একবার তার বিড়াল হারিয়েছিল, তখন সে রাস্তায় রাস্তায় হয়রান হয়ে খুঁজতে লাগলো, কারো বাচ্চা হারালে যেমন হাউমাউ করে কাঁদে, তেমনই সে কাঁদতে লাগলো রাস্তায় হেঁটে হেঁটে খুঁজতে খুঁজতে। তারপর অনেক কষ্টের পর খুঁজে পেয়েছে। সে কী খুশি তার! তারপর আবার হারালো, তখন সে পাগলের মত হয়ে গেলো। এই যে এতো বাড়াবাড়ি, এসব তো ইসলামে জায়েয হবার কোনো সুরত নেই।’
তিনি বলেন, ‘বিড়ালের প্র্রতি দয়া করা আল্লাহর মাখুলক হিসাবে ঠিক আছে। কিন্তু এতে বাড়াবাড়িরকমের অপচয় করা, এর জন্য এতো বেশি ভালোবাসা দেখানো যে, নিজের ছেলেমেয়েদের চেয়েও বেশি ভালোবাসা হয়ে যায়। এর প্র্রতি এতো ভালোবাসা দেখানো যে, আল্লাহ-রাসুলের ভালোবাসায় ঘাটতি এসে যায়। এগুলা তো হারাম। এমনে বিড়াল পালাতো সমস্যা নেই।
তিনি জানান, ‘এজন্য আমি বলতে চাই, একটা বিড়াল কিনতেই যদি লাগে ৫০ হাজার টাকা, আর তার পিছনে যদি প্র্রতি মাসে মোটা অংকের এতো এতো ব্যয় করা লাগে, এসব টাকা মানলাম ১০ হাজার টাকা ব্যয় হয়, তাহলে এই ১০ হাজার টাকা বাসায় যদি কাজের বুয়া থাকে, তাকে আপনি বেতন দেন কত? দুই হাজার দিতেই কত গরিমশি করেন। আপনি বিড়ালের পিছনে খরচ করেন ১০ হাজার, অথচ আপনার বাসার বুয়ার পরিবার চলে না। আপনি যদি একজন অসহায় পরিবারকে ১০ হাজার টাকা দেন, তাহলে আরামে স্বাচ্ছন্দে তারা থাকতে পারে। কতো পরিবার আছে, সবাই বিকলাঙ্গ, বাবাও অন্ধ, মাও অন্ধ, ছেলেমেয়ে কোনো কাজ করতে পারে না। এদেরতো চলার উপায় নাই। কাজের ব্যবস্থাও নাই। এদেরকে যদি আপনার বিড়াল পোষার টাকাটা দেন, তাহলে কতো বড় সওয়াব হবে।’
তিনি বলেন, ‘কেউ কেউ আবার বিড়াল সংক্রান্ত হাদিস দিয়ে বিড়াল পালাকে সওয়াবের কাজ মনে করছে, তাদেরকে বলতে চাই, বিড়াল পালা জায়েয, বিড়ালের প্র্রতি জুলুম না করে দয়া দেখানো সওয়াবের কাজ। কিন্তু তার জন্য অর্থ ব্যয় করতে হবে কেন!’
হাদিসে বিড়াল প্রসঙ্গে কী রয়েছে –
হাদিসের দৃষ্টিতে বিড়াল পালনে কোনো অসুবিধা নেই। তবে আটকে রেখে খাদ্য খাওয়ার সুযোগ না দিয়ে কষ্ট দেওয়াকে ‘আজাবের কারণ’ হিসাবে ধরা হয়েছে। হজরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘জনৈক মহিলাকে একটি বিড়ালের কারণে আজাব দেওয়া হয়। সে বিড়ালটিকে বন্দি করে রাখে, এ অবস্থায় সেটি মারা যায়। সে এটিকে বন্দি করে রেখে পানাহার করায়নি এবং তাকে ছেড়েও দেয়নি, যাতে সে (নিজে) জমিনের পোকা-মাকড় খেতে পারে। ‘ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩৪৮২)
বিড়ালের ঝুটার বিধান প্রসঙ্গে হজরত কাবশা বিনতে কাব ইবনে মালিক রা. হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, ‘আবু কাতাদা রা. আমার কাছে আগমন করলেন। আমি তার জন্য পানিভর্তি একটি অজুর পাত্র উপস্থিত করলাম। এসময় একটা বিড়াল তা থেকে পানি পান করল। তিনি ওই বিড়ালটির জন্য পাত্রটি কাত করে দিলেন। যাতে সে নির্বিঘ্নে পান করতে পারে। কাবশা রা. বলেন, তখন আবু কাতাদা রা. দেখলেন আমি তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। তিনি বললেন, হে ভাতিজি! তুমি কি আশ্চর্য বোধ করছ? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, রাসুল সা. বলেন, ‘এরা (বিড়াল) অপবিত্র নয়, এরা তোমাদের আশেপাশে বিচরণকারী এবং বিচরণকারিনী।’ (নাসায়ি: ৩৪১)
বিড়াল কেনা-বেচা সম্পর্কে রাসুল সা.-কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি ধমক দিয়েছেন। হজরত আবু জুবাইর রহ. বলেন, ‘আমি জাবের রা.-এর কাছে কুকুর ও বিড়াল কেনা-বেচা করার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, নবী (সা.) এ ব্যাপারে সাবধান করে দিয়েছেন।’ (মুসলিম: ১৫৬৯)
হজরত জাবির ইবনে আব্দুুল্লাহ রা. বলেন, ‘রাসুল সা. কুকুর ও বিড়ালের বিক্রয় মূল্য গ্রহণ করতে নিষেধ করেছেন।’ (আবু দাউদ: ৩৪৭৯)