আমি ইয়াসমিন সুলতানা। পরিবারের সবচেয়ে ছোট সন্তান। বাবা ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী। ছোটবেলা থেকেই অনেক আদরে মানুষ হয়েছে সরকারি চাকরির সুবাদে বিভিন্ন জেলায় থেকেছি সব সময় সরকারি অফিসার্স কোয়ার্টারে থাকা হয়েছে এবং সরকারি গাড়িতে চড়ে স্কুল জীবন পার করেছি।
আমার পরিবার কখনো ছেলে-মেয়ে ভেদাভেদ করেনি আমরা ভাই-বোন একইভাবে সমান অধিকার এবং সুযোগ-সুবিধা নিয়ে মানুষ হয়েছি ।ছোটবেলা থেকেই যখন যা চেয়েছি পেয়েছি। সাইকেল চালানো থেকে শুরু করে পিস্তল, বন্দুক রাইফেল, সবকিছুই চালানো শেখানো হয়েছে আমাকে।
কথা আছে অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকিয়ে যায়। আমারও এই সুখ বেশিদিন থাকলো না। এইচএসসি পরীক্ষা দেয়ার পর বাবা হঠাৎ করেই না ফেরার দেশে চলে যান আমরা অথৈ সাগরে নিমজ্জিত হই। নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে যে স্বপ্ন ছিল যে ইচ্ছা ছিল মুহূর্তেই তা ধুলিস্যাৎ হয়ে যায়।
এই সময়টা কাছের মানুষদের অনেক রূপ দেখেছি। পৃথিবী কত নিষ্ঠুর হতে পারে সেটা দেখেছি। এই সময়টা এমনও দিন আমরা পার করেছি যে শুধুমাত্র ডাল ভাত খেতে হয়েছে। না কোন অর্থের অভাব সেই মুহূর্তে ছিল না কিন্তু অর্থ কোথায় ছিল সেটাই আমাদের জানা ছিল না ।কারণ হঠাৎ করে বাবা মারা যাওয়ার কারণে কোথায় কি ছিল আমরা কিছুই জানতাম না ।আর যাদের কাছে টাকা-পয়সা ছিল বা পেতাম তারাও সেই মুহূর্তে নীরব ভূমিকায় ছিলেন। যার কারণে প্রথম ছয় মাস থেকে এক বছর আমাদের দুর্বি সহ দিন কেটেছে।
যেহেতু বাবা ছিলেন না, আত্মীয় স্বজনের খোঁজ খবর ছিল না, পাড়া-প্রতিবেশীদের কানাঘুষা সবকিছু মিলিয়ে হঠাৎ করেই অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে বিয়ে হয়ে যায় আমার। এখানে এসে শুরু হয় নতুন সমস্যা দুই পরিবারের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য হবার কারণে মানসিকতার এক বিশাল দূরত্ব তৈরি হয়। খুবই স্বাধীনচেতা মানুষ আমি পড়াশোনা আমার ধ্যান-জ্ঞান ছিল। নিজের ক্যারিয়ার তৈরি করাটাই সবার আগে ছিল। কিন্তু এখানে এসে সেই সব কিছুতেই আমি বাধা প্রাপ্ত হই। আবারো নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে হুমকির মুখে পড়ে যাই।
বিভিন্ন বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে নিজের বাসায় থেকে পড়াশোনা করতে থাকি এভাবেই অনার্স মাস্টার্স কমপ্লিট হয়। মাস্টার্স কমপ্লিট হবার আগেই কোল জুড়ে আসে আমাদের প্রথম সন্তান। শুরু হয় নতুন জীবন যুদ্ধ ।সন্তানের দুই মাস বয়সে প্রথম বিসিএসে অংশগ্রহণ করে সেখানে উত্তীর্ণ হই। কিন্তু পরবর্তী ধাপে আর পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব হয় না কারণ বাচ্চা ছোট ছিল পড়ার সময় পাচ্ছিলাম না।
তখন আমার বোঝা হয়ে গিয়েছিল যে চাকরি হয়তো আমার পক্ষে করা সম্ভব হবে না। কারণ চাকরির প্রিপারেশন নেওয়ার মতো সুযোগ আমি পাব না। তাই পড়াশুনাকেই আবারও টার্গেট করে একই সাথে মাস্টার্স, বিএড এবং এলএলবি পড়া শুরু করি।
এলএলবি সম্পূর্ণ করার পরে আমি শিক্ষানবিশ আইনজীবী হিসেবে কোর্টে প্র্যাকটিস শুরু করি। এ সময়টা আমার পরিবার আমাকে অনেক সাপোর্ট দিয়েছে যার কারণে আমি কোর্টে যেতে পারতাম বাচ্চাকে রেখে ।এভাবে সাড়ে তিন বছর কোর্টে প্র্যাকটিস করতে থাকি এডভোকেটশিপ পরীক্ষা দেয়ার আগে আমার দ্বিতীয় বেবির উপস্থিতি আমরা টের পাই ।যার ফলশ্রুতিতে পরীক্ষাটা আর দেয়া হয় না।
দ্বিতীয় বেবি হবার পরে বেবি এবং আমি অসুস্থ থাকতে লাগলাম ।যার কারণে কোর্টে আর ফিরে যাওয়া হলো না ।কিন্তু কিছু একটা করা দরকার, আর কোর্টে থাকা অবস্থায় ইচ্ছা ছিল নারীদের জন্য কিছু করার সে চিন্তা ভাবনা থেকেই শুরু করি উদ্যোক্তা জীবন। যশোরের ঐতিহ্যবাহী হাতের কাজের পণ্য নিয়ে প্রথম একটি পেজ খুলি যার নাম "নান্দনিক সমাহার"
অনলাইনে আমার উদ্যকতা জীবন শুরু হয়। ধীরে ধীরে আমার প্রতিষ্ঠান জনপ্রিয়তা পেতে থাকে। বিশেষ করে যশোর ঐতিহ্যবাহী নকশি কাঁথা এবং হাতের কাজের সকল ধরনের পণ্য ।এরপর এর সাথে আস্তে আস্তে যোগ করি যশোরের ঐতিহ্যবাহী খেজুরের গুড়, কুমড়া বড়ি ইত্যাদি।
নিজেকে পারফেক্টভাবে তৈরি করার জন্য আমি অনলাইন এবং অফলাইনে বিভিন্ন ট্রেনিং এ অংশগ্রহণ করি। শেখার কোন শেষ নেই শেখার কোন বয়স নেই। তাই সুযোগ পেলেই শিখতে খুব ভালোবাসি এবং বর্তমানে প্রশিক্ষক হিসেবে শেখাতেও ভালোবাসি।
এরই মাঝে ২০২০ সালে ওমেন এন্ড ই-কমার্স ট্রাস্ট উই এই প্লাটফর্মে যুক্ত হই। ২০২১ সালে এই প্লাটফর্ম থেকে যশোরের জেলা প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হই ।এবং ২০২৩ পর্যন্ত প্রতিনিধি হিসেবে যশোর জেলার আটটি উপজেলার তৃণমূল নারীদেরকে নিয়ে আমি কাজ করেছি।
বর্তমানে বিভিন্ন সংস্থার সাথে প্রশিক্ষক হিসেবে আমার নান্দনিক সমাহার প্রতিষ্ঠান থেকে নারীদেরকে বিভিন্ন বিষয়ে ট্রেনিং দিয়ে স্বাবলম্বী করার চেষ্টা করছি।
Women and e-commerce trust WE থেকে basic এবং advance masterclass করেছি।
ICT Division থেকে WiFi, Facebook marketing training করেছি।
e-Cab , UNDP থেকে ও বেশ কিছু ট্রেইনিং করার সুযোগ হয়েছে।
Bangladesh Hi-tech park authority থেকে "Professional Digital Content Management" এর কোর্স করেছি।
BIID থেকে "Digital Skills on Financial Management and access to Finance" এর উপর কোর্স করেছি। BITM থেকে" Mastering Facebook marketing" training করেছি।
Bangladesh Computer Council থেকে "Development of women entrepreneurship" ট্রেনিং করেছি। Ministry of commerce থেকে ট্রেনিং করেছি। এছাড়াও আরো বেশ কিছু ট্রেইনিং করেছি।
আমার নান্দনিক সমাহারের পণ্য দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশ যাচ্ছে। ভারত, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, স্পেন, রাশিয়া ইত্যাদি দেশে গিয়েছে।
এখানে এসে আমি এক নতুন পরিচয় পেয়েছি এবং অনেক নারীদেরকে নিয়ে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। এছাড়াও এই সবকিছুর পাশাপাশি নারীদেরকে আরো সহযোগিতা করার লক্ষ্যে নিজের প্রতিষ্ঠান "নান্দনিক সমাহার" থেকে বিভিন্ন সংস্থার সাথে যুক্ত হয়ে প্রশিক্ষক হিসেবে তাদেরকে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি যেন তারা কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে পারে আমার প্রতিষ্ঠান থেকে কাজ শিখে।
২০২৩ সালের ০৯ ই ডিসেম্বর বেগম রোকেয়া দিবসে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার হতে বাংলাদেশ মহিলা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হিসেবে শ্রেষ্ঠ জয়িতা নির্বাচিত হয়েছি আলহামদুলিল্লাহ।
আমরা নারী ,আমরাই পারি। আমরা চেষ্টা করলে অনেক কিছুই করতে পারি। সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি, নারীদেরকে নিয়ে তাদেরকে নিজ পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করতে।
এছাড়াও যেহেতু আমার সাড়ে তিন বছরের প্র্যাকটিস জীবনের অভিজ্ঞতা আছে এবং এলএলবি পড়েছিলাম তাই নারীদের সহায়তার জন্য একটি গ্রুপ আছে যার নাম "women Fix the World" এই গ্রুপে নারীদের মানসিক এবং আইনি সহায়তা প্রদান করার চেষ্টা করছি। মানসিকভাবে তাদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি এবং আইনি কোন জটিলতা তৈরি হলে সেটা সমাধান করার চেষ্টা করছি।
আমাদের জীবনটা খুব ছোট এবং খুব সহজ কিন্তু আমরাই আমাদের জীবনটাকে জটিল করে ফেলছি ।
স্বপ্ন দেখি একসময় আমার প্রতিষ্ঠান" নান্দনিক সমাহার "থেকে হাজার হাজার নারী কাজ শিখে কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবে ।সেভাবেই চেষ্টা করে যাচ্ছি ।
সবাই আমার জন্য এবং আমার বাচ্চাদের জন্য দোয়া করবেন। তারা যেন মানুষের মত মানুষ হতে পারে।